
পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী। নদী তিনটির সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক এবং জাতিগত পরিচয় সংযুক্ত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা জয়ধ্বনি দিতেন পদ্মা- মেঘনা - যমুনা তোমার আমার ঠিকানা বলে। মূলত গঙ্গার নিম্ন স্রোতধারার নাম পদ্মা। আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় গোয়ালন্দ ঘাটে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গম স্থলের পরবর্তী মিলিত প্রবাহই পদ্মা নামে অভিহিত। বাংলাদেশে গঙ্গার প্রবেশ স্থল (নবাবগঞ্জ জেলাধীন শিবগঞ্জ উপজেলার মানাকোসা ও দুর্লভপুর ইউনিয়ন) থেকে নদীটি পদ্মা নামে বহুল পরিচিত। এই নামটি (পদ্মা) গঙ্গা নদীর ডান তীর থেকে বিভক্ত হয়ে আসা ভাগীরথী নামক শাখাটির উৎসস্থল পর্যন্ত ব্যবহূত হয়, এবং হিন্দুমতে এই ধারাটিই গঙ্গার ধর্মীয় পবিত্রতা বহন করে। নদীজ ভূমিরূপ বিদ্যাগতভাবে যমুনার সাথে সঙ্গমস্থলের পূর্ব পর্যন্ত প্রবাহটিকে গঙ্গা নামে এবং সঙ্গমস্থল পরবর্তী নিম্নস্রোতধারাকে পদ্মা নামে অভিহিত করা অধিকতর সঠিক। ব্রহ্মপুত্রের স্থানান্তরিত প্রবাহের ফলে এই নদীখাতের সৃষ্টির কারণে শুধুমাত্র নয় বরং বৎসরের অধিকাংশ সময়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা গঙ্গার তুলনায় পদ্মার প্রবাহে অধিকতর ভূমিকা রাখে।পদ্মা নদী ১২০ কিমি দীর্ঘ এবং ৪ থেকে ৮ কিমি প্রশস্ত।গঙ্গা-পদ্মা হল প্রধান জলশক্তি (hydrodynamic) প্রণালী পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ ভূমি গড়ে তুলেছে যা দেশের একটি বিরাট অংশ এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বৃহত্তর একটি অংশ অধিকার করে আছে। পদ্মা দেশের প্রধানতম নদী। এর উপরে দেশের সর্ববৃহৎ ব্রিজ নির্মিত হচ্ছে। পদ্মনদীর বক্ষে নিয়মিত যাতায়াত করলেও, আমরা অনেকেই পদ্মানদীর উৎপত্তি সম্পর্কে জানি না। আমরা জানি না যে পদ্মানদীর প্রকৃত নাম কি? পদ্মানদী একটি সংক্ষিপ্ত নাম। কিন্তু এর প্রকৃত নাম পদ্মাবতী। দেবী লক্ষ্মীর নাম পদ্মাবতী। ঋগ্বেদের শ্রীসূক্তেও লক্ষ্মীর পদ্মেস্থিত পদ্মবর্ণা পদ্মিনী বা পদ্মা নামটি পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের শাকল শাখার অন্তর্ভুক্ত দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূক্তটি বৈদিক 'শ্রীসূক্ত'। বঙ্গদেশে দশমণ্ডল যুক্ত শাকল শাখাই প্রচলিত। তবে ঋগ্বেদের বাস্কল শাখাসহ অন্য কয়েকটি শাখায় শ্রীসূক্তকে মূল মন্ত্রসংহিতার অভ্যন্তরেই পাওয়া যায়।
"হে জাতবেদ অগ্নিদেব! সুবর্ণবর্ণা, হরিণীর মত চঞ্চল, সোনা এবং রূপার বিবিধ মালায় বিভূষিত ; পূর্ণিমার চন্দ্রের মত প্রকাশমানা, হিরণ্ময়ী লক্ষ্মীকে আমার জন্য আহ্বান করুন।
হে জাতবেদ অগ্নিদেব! নিম্নগমনরোধকারী সেই লক্ষ্মীকে আমার জন্য আহ্বান করুন। যিনি আহূতা হলে আমি স্বর্ণ, গো, অশ্ব, পুত্র মিত্রাদি প্রাপ্ত হব।
অশ্ব যাঁর পুরােভাগে, রথাসীনা হস্তীর বৃংহণ নাদ দ্বারা যিনি প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাপিকা; সেই শ্রীদেবীকে আমার নিকট আহ্বান করুন, তিনিই আমাকে কৃপা অনুগ্রহ করবেন।
ব্রহ্মারূপা, স্মিতহাস্যকারিনী, সুবর্ণাদির দ্বারা পরিবেশিষ্টা, আর্দ্রা, প্ৰকাশমানা, প্রসন্নবদনা, ভক্তের মনােবাঞ্ছাপূর্ণকারিণী, পদ্মাসীনা, পদ্মবর্ণা সেই শ্রীদেবীকে আহ্বান করি।
চন্দ্রের ন্যায় প্রভাসম প্রকাশমানা, নিজ যশে প্রজ্জ্বলিত, জগতের শ্রীস্বরূপা, ইন্দ্রাদিদেবসেবিতা, পদ্মিনীর শরণ গ্রহণ করছি। হে শ্রীদেবি! আমার দুর্ভাগ্যসূচক অলক্ষ্মী বিনষ্ট হােক, আমি তোমার শরণ নিলাম।"
ভগবান নারায়ণের শক্তি পদ্মাবতী লক্ষ্মীই দেবী সরস্বতীর অভিশাপে পদ্মাবতী নদী বা পদ্মানদী নামে প্রবাহিত হয়। ঘটনাটি ব্রহ্মবর্তেপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডে সুবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। ভগবান নারায়ণ দেবী লক্ষ্মীকে বললেন, হে লক্ষ্মী তুমি সরস্বতীর শাপে যেহেতু শাপগ্রস্ত হয়েছ, তাই তুমি তোমার কলাংশে নদীরূপ ধারণ করে শীঘ্র ভারতভূমে পদ্মাবতী নামে অবতীর্ণা হও। ভগবান নারায়ণ লক্ষ্মী দেবীকে এ কথাও বলে দেন যে, পদ্মাবতী লক্ষ্মীর সাথে সাথে পশ্চাৎ বিশ্বপাবনী হয়ে গঙ্গা নদীও অবতীর্ণা হবেন।
" হে বরাননে লক্ষ্মি ! তুমি ভারতীর শাপ-প্রভাবে তোমার কলাংশে নদীরূপ ধারণ করে শীঘ্র ভারতভূমে গমন করে পদ্মাবতী নামে অবতীর্ণা হও। হে গঙ্গে! পশ্চাৎ তুমিও ভারতীর শাপবশত অংশরূপে বিশ্বপাবনী হয়ে শরীরী মাত্রের পাপরাশি ভস্মসাৎ করিবার নিমিত্ত ভারতে অবতীর্ণা হবে।"
পদ্মাবতী লক্ষ্মীর এক অংশ ভারতী বা সরস্বতীর শাপে পদ্মাবতী নদীরূপে ভারতে অবতীর্ণা হয়ে স্বয়ং হরি-সমীপেই অবস্থান করতে লাগলেন।
"পদ্মাও ভারতী-শাপে স্বীয় অংশে পদ্মাবতী নদীরূপে ভারতে অবতীর্ণা হলেন এবং স্বয়ং হরি-সমীপেই অবস্থান করতে লাগলেন। পরবর্তীতে লক্ষ্মীর অপর অংশ ভারতে ধর্মধ্বজরাজের তনয়ারূপে অবতীর্ণা হয়ে তুলসীনামে বিখ্যাতা হলেন । পদ্মা সরস্বতী-শাপে এবং হরি বাক্যে অংশরূপে বিশ্বপাবনী বৃক্ষরূপা হলেন। তিনি কলির পঞ্চসহস্র বৎসর পর্য্যন্ত ভারতে অবস্থান করে তৎপরে নদীরূপ পরিত্যাগ করত হরির সমীপে গমন করবেন।"
লক্ষ্মীরূপা পদ্মার পবিত্র জলে স্নান করে পাপিতাপি তাদের পাপ দূর করবে। এতে পদ্মার জল পাপক্লিষ্ট হবে। কিন্তু ভগবানের সেবক সাধুসন্ত যখন সেই জলে অবগাহন করে স্নান করবে, তবেই পদ্মানদীর জলধারা পাপি-প্রদত্ত পাপরাশি হতে মুক্তি লাভ করতে পারবে।
" হে কমলে! তুমিও কলাংশের অংশে পদ্মাবতী নদীরূপা ও তুলসীবৃক্ষরূপা হয়ে ভারতভূমে গমন কর। কলির পঞ্চসহস্র বৎসর অতীত হলে, তোমাদের শাপ মোচন হবে, তৎপরে আমার গৃহে তোমরা পুনরায় আগমন করবে। হে পদ্মে! তুমি প্রাণিমাত্রের সম্পদের কারণ এবং বিপত্তিরও একমাত্র কারণ, তা না হলে এ জগতে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি ভিন্ন কারা ধর্মের সমাদর করে ? আমার মস্ত্রোপাসক ব্যক্তিগণের স্নান এবং অবগাহনে তোমরা পাপি-প্রদত্ত পাপরাশি হতে মুক্তি লাভ করতে পারবে। হে সুন্দরি ! পৃথিবীতে যে সমস্ত অসংখ্য তীর্থ আছে, সকলেই আমার ভক্তের স্পর্শন ও দর্শনে পবিত্র হয়। হে সতি! আমার মন্ত্রোপাসক মনোহর পবিত্র ভক্তবৃন্দ, ভারতকে পবিত্র করার নিমিত্তে ভারতে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করে। আমার ভক্তগণ যেখানে অবস্থান করে এবং এবং যে স্থানে পাদ প্রক্ষালন করে, সেই সকল স্থানই পবিত্র হয়ে মহাতীর্থ বলে পরিগণিত হয়। স্ত্রীঘাতী, গো-হননকারী, কৃতঘ্ন, ব্রহ্মঘাতী ও গুরুর স্ত্রী হরণকারী মহাপাপী ব্যক্তিগণও আমার ভক্তের স্পর্শনে ও দর্শনে পবিত্র হয়ে জীবন্মুক্ত হয় ।"
পদ্মাবতী বা পদ্মনদীর জল যে অত্যন্ত পবিত্র। পদ্মানদী স্বয়ং লক্ষ্মীরূপা। গঙ্গানদীতে স্নানে যে পুণ্য লাভ হয়, তেমনি পুণ্যলাভ হয় পদ্মানদীতে অবগাহন করলে। এ শাস্ত্রীয় বিষয়টি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা দূরে থাক সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই যথাযথভাবে জানে না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং পরিতাপের। লক্ষ্মীর অংশে যে নদীর জন্ম, সে নদীর জল স্বভাবতই পবিত্র। তাই আমরা সকল আধ্যাত্মিক কৃত্যাদি পদ্মানদীর জলে অনায়াসেই করতে পারি।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ
1